ঠিক এই মুহুর্তে ধ্রুব পুলের উপর বসে আছে। আর দেখছে দূরের আকাশটাকে। আকাশে ভাসমান মেঘগুলোকে দেখছে আর ভাবছে কি সুন্দর ও আশ্চর্যময় মেঘেদের জীবন! ওর ইচ্ছে করছে মেঘেদের মাঝে হারিয়ে যেতে। ধ্রুব-র মাঝেমধ্যে হারিয়ে যেতে খুবই ইচ্ছে হয়। ওর ধারণা হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে এক ধরণের আনন্দ আছে। কেননা হারিয়ে যাওয়ার প্রথম কয়েকটি দিন সবাই তাকে খুবই খুঁজবে। অনেকেই বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে সে হারিয়ে গেছে। কিন্তু অবশেষে কোন এক সময় এই বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের খেলা শেষে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সেদিন সত্যি সত্যি ধ্রুব সবার মন থেকেও হারিয়ে যাবে। এরপর হঠাৎ করে একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হবে। সেদিন সবাই দারুণভাবে অবাক হবে। তখন ধ্রুব হাসবে। তবে সবার সামনে হা হা হা করে নয় বরং মনে মনে সে হাসবে এবং হাসতেই থাকবে। সে হাসবে কারণ তার প্রত্যাবর্তনে যাদের স¦ার্থে আঘাত আসবে তারা তার সাথে কেমন মিথ্যে আচরণ করবে তাই দেখে সে হাসবে। হাসতে হাসতে তার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠবে কিন্তু মুখ দিয়ে সামান্যতম শব্দও বেরুবে না। আবার যারা সত্যি সত্যিই তাকে ভালবাসে তাদের সেদিনের কান্না দেখেও তার আনন্দ হবে। কেননা ভালবাসা বিষয়টিকে ধ্রুব দারুণভাবে উপভোগ করে। মোট কথা হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা এই দুটোর মধ্যে সে খুবই আনন্দ পাবে বলে ওর বিশ্বাস। কিন্তু আজও তার একবারও হারিয়ে যাওয়া হল না। চেষ্টা করলে সফল হতে পারত না তা নয়, আসলে সে কোনদিনই চেষ্টা করেনি। এর মধ্যে পশ্চিম আকাশে দেখল কতকগুলো সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। সাদা বক! উড়ে যাওয়া সাদা বক ওর খুবই প্রিয় জিনিসের মধ্যে একটি। ছোট বেলায় দেখত বক শিকারীরা বক মারতে আসত। শিকারীরা বক মারার জন্য বিশেষ এক ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার করত। প্রায় একফুট ব্যসার্ধের একটা খুপড়ি বানাত। খুপড়ির ভেতরে শিকারী অবস্থান করত। খুপড়িটি বানানো হত কলাপাতার আবরণে। এরকম দুইটা খুপড়িতে দুইজন অবস্থান করত। খুপড়ীর উপরের দিকে থাকত ফুটো। মাঝখানে একটা লাঠিতে একটি বা দুটি বক বেঁধে দোলানো হত। শিকারীরা বকেদের মত আওয়াজ করতে পারত। সেই বাঁধানো বক এবং আওয়াজ শুনে পাশের বাঁশ বাগান হতে অন্যান্য বকেরা আসত। এসে খুপড়ির উপরে বসত। আর ঠিক তখনই নীচ থেকে শিকারী বকটির পা টেনে ভিতরে ঢুঁকিয়ে নিত। ব্যাপারটা তাকে খুবই নাড়া দিত। খুব খারাপ লাগত তার। তার প্রিয় একটা জিনিস এভাবেই চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথচ সে কিছুই করতে পারছে না ভাবতেই তার খারাপ লাগত। আজ সেই উড়ে যাওয়া সাদা বকদের দেখে সেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সন্ধ্যা নেমে এল। চারিদিকে কোন লোকজন নেই। হালকা হালকা বাতাস বইছে। আকাশের মেঘগুলোকে এখন রক্তিম হলুদাভ লাগছে। সাদা বকের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সাদা মেঘ অন্যরকম হয়ে গেছে তা সে খেয়ালই করে নি। এমন সময় ওর মনে হল কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে একেবারে স্থির হয়ে। ব্যাপারটা মনে হতেই বহমান ঠান্ডা বাতাসে শরীরে হালকা কাঁপুনি খেলে গেল। গাঁয়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। ধ্রুবর মনে প্রশ্ন জাগল সত্যিই কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে নাকি তার মনের ভুল? একবার ভাবল ঘুরে দেখবে না, কে হয় হবে। কিন্তু এমনটি সে করতে পারল না। মানুষের মস্তিষ্ক অনেক সময় অনেক কাজ নিজে থেকেই করে ফেলে। কাজেই নিজের অজান্তেই ধ্রুব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল।...